ক্যান্সার কেবল একটি মাত্র রোগ নয়। এটি অনেকগুলো জটিল ব্যাধির সমষ্টি। মানব দেহে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ দ্বারা গঠিত। সুস্থ দেহে এ কোষগুলি নিয়মিত ও সুনিয়ন্ত্রিত কোষ – বিভাজন পদ্ধতির মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে বৃদ্ধি সাধন ও ক্ষয় রোধ করে। সম্ভবত একটি মাত্র কোষ থেকে ক্যান্সার রোগের উৎপত্তি হয়ে থাকে। কোন অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ করে কোন একটি কোষ অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন শুরু হয়ে যায় এবং বিরামহীনভাবে তা চলতেই থাকে। ফলে অচিরেই সেখানে একটি পিন্ডের বা টিউমারের সৃষ্টি হয়।
ক্ষতিকর টিউমার হলে তা স্থানীয়ভাবে আশেপাশে অনুপ্রবেশ করে এবং লসিকা বা রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে শরীরের দূরবর্তী স্থানে গিয়ে নতুন বসতি স্থাপন করে – যাকে বলা হয় মেটাস্টেসিস।
কী কারণে ক্যান্সার হয়?
ক্যান্সার সংক্রামক ব্যাধি নয়। ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান, ‘হরমোন’ তেজস্ক্রিয়তা, পেশা, অভ্যাস (ধূমপান, তামাক সেবন, মদ্যপান ইত্যাদি), আঘাত, প্রজনন ও বিকৃত যৌন আচরণ, বায়ু ও পানি দূষণ, খাদ্য (যেমন অত্যাধিক চর্বি বা অধিক চর্বিযুক্ত খাদ্য), বিভিন্ন বর্ণগত, জীবন যাপন পদ্ধতিগত, ভৌগোলিক ও পরিবেশগত প্রভাব, ‘প্যারাসাইট’ ও ‘ভাইরাস’ সাধারণতঃ সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত ক্যান্সার সৃষ্টির কারণ এবং এর প্রায় ৯০ শতাংশই এড়িয়ে চলা সম্ভব।
বাংলাদেশে ক্যান্সারের প্রকোপ
বাংলাদেশে প্রতি বছর আনুমানিক ২,০০,০০০ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ১,৫০,০০০ লোক এ রোগে মৃত্যুবরণ করে। ক্যান্সারের সার্বিক প্রতিরোধ, সত্বর ও সঠিক রোগ নির্ণয় ও উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে এই সংখ্যা অনেক কমানো সম্ভব।
ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি সমূহ
সাধারণত ক্যান্সার তিনটি পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই সাথে একাধিক পদ্ধতি প্রয়োগের প্রয়োজন হতে পারে।
সার্জারী বা শল্য চিকিৎসা
প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার আক্রান্ত স্থানকে অপারেশনের মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে কেটে বাদ দিয়ে শরীরকে ক্যান্সার মুক্ত করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে ক্যান্সার নিরাময় সম্ভাবনা সর্বাধিক।
রেডিওথেরাপি বা বিকিরণ চিকিৎসা
অধিকাংশ ক্যান্সার রোগীর ক্ষেত্রে সার্জারী কিংবা অন্যান্য চিকিৎসা পাশাপাশি অথবা এককভাবে রেডিওথেরাপির সাহায্যে শরীরের ভিতরেই ক্যান্সার কোষগুলো ধ্বংস করে ফেলা যায়।
কেমোথেরাপি
কোন কোন ক্ষেত্রে সার্জারী এবং রেডিওথেরাপির পাশাপাশি অথবা পূর্বে বা পরবর্তীতে ক্যান্সার কোষ ধ্বংসকারী ঔষধের সাহায্যে চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
বস্তুত রোগ এবং রোগীর অবস্থাভেদে সার্জারী, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি বা অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা হয়। তবে রোগের প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করলে ক্যান্সার সম্পূর্ণরূপে নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
হরমোন থেরাপি এবং টার্গেটেড থেরাপি
উপরোক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি ছাড়াও হরমোন সংবেদনশীল ক্যান্সারের চিকিতসায় হরমোন থেরাপি এবং বিশেষ কিছু ক্যান্সারের চিকিতসায় টার্গেটেড থেরাপি প্রদান করা হয়।
ক্যান্সারের বিপদ সংকেত সমূহ
• সহজে সারছে না এমন কোন ক্ষত
• অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ
• স্তনে বা শরীরের অন্য কোথাও ব্যথাযুক্ত বা ব্যথাবিহীন কোন পিন্ডের সৃষ্টি
• গিলতে অসুবিধা বা হজমে গন্ডগোল
• মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাস পরিবর্তন
• তিল বা আঁচিলের সুস্পষ্ট পরিবর্তন
• খুসখুসে কাশি কিংবা ভাঙা কন্ঠস্বর
উপরে উল্লেখিত ক্যান্সারের যে কোনও বিপদ সংকেত দু’সপ্তাহের বেশী স্থায়ী হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ক্যান্সার প্রতিরোধ
শুধু মাত্র জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্ধেক ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব
ক্যান্সার এর উৎপত্তি কখনো ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল নয়। প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন-ই ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুলাংশে কমাতে সক্ষম ।
ধূমপান পরিহার করুণ
সারাবিশ্বে ধূমপান ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ যা কিনা সব ধরনের ফুসফুস ক্যান্সারের জন্য দায়ী। এছাড়াও ধূমপানের ফলে মুখ ও গলা, শ্বাসনালী, মূত্রথলি, অন্ত্রের ক্যান্সার এবং হৃদরোগের মত মারাত্নক ব্যাধির সৃষ্টি হয়।
যদি আপনি ধূমপায়ী হয়ে থাকেন, তবে তা পরিহার করাই আপনার সুস্বাস্থ্যের জন্য সব চাইতে প্রয়োজনীয়/অপরিহার্য। যত শীঘ্রই আপনি তা পরিহার করবেন তত বেশী দেহের ক্ষতিসাধন রোধ করা সম্ভব।
মদ্যপানের ক্ষতি সম্পর্কে জানুন
অতিমাত্রায় যে কোন ধরণের মদ্যপান ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। এর সাথে যদি আপনি ধূমপায়ী হয়ে থাকেন তবে ক্যান্সারের ঝুঁকি আরও মারাত্নক আকার ধারণ করে। মদ্যপানে যকৃত, খাদ্যনালী, কন্ঠ, গলা নালী ও ফুসফুসের ক্যান্সার হয়ে থাকে। অতএব মদ্যপান পরিহার করুন।
সক্রিয় থাকুন
নিয়মিত হালকা পরিশ্রম আপনার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে। সপ্তাহে নিয়মিত তিন থেকে পাঁচ দিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম (যেমন – হাঁটা, জগিং বা সাঁতার কাটা, বাগান করা, সাইকেল চালানো ইত্যাদি) যা আপনার জন্য উপযোগী তা করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
স্বাস্থ্য সম্মত খাদ্যাভাস গড়ে তুলুন
ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে নিয়মিত সুষম এবং পরিমিত খাদ্যাভাস গড়ে তুলুন। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণে আঁশযুক্ত খাবার, শাক-সবজি, ফলমূল রাখুন এবং প্রক্রিয়াজাত ও অধিক চর্বিযুক্ত খাদ্য পরিহার করুন। প্রচুর পরিমাণে (দৈনিক ৮-১০ গ্লাস) পানি পান করুন।
সূর্যের ক্ষতিকর রশ্নি থেকে নিজেকে দূরে রাখুন
অতিমাত্রায় সূর্যরশ্নি শরীরের জন্য ক্ষতিকর, যা কিনা মেলানোমা এবং ত্বকের (স্কিন) ক্যান্সারের জন্য দায়ী। গ্রীষ্মকালে সকাল ১১:০০টা হতে বিকাল ০৩:০০টা পর্যন্ত সূর্যের আলো থেকে দূরে থাকুন অথবা এ সমইয় ছাতা, সানগ্লাস এবং সানস্ক্রীন ব্যবহার করুন।
সুস্বাস্থ্য বজায় রাখুন
শরীরের অতিরিক্ত ওজন কেবল হৃদপিন্ডের অসুখই নয়, ডায়বেটিস এমনকি ক্যান্সারের মত মারাত্নক ব্যাধির সৃষ্টি করে। মাত্রাতিরিক্ত ওজন স্তনের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের জন্য দায়ী। অতরব, শরীরের ওজন পরিমিত রাখুন।
নিয়মিত ক্যান্সার স্ক্রিনিং বহু জীবন বাঁচাতে সক্ষম
নিয়মিত স্ক্রিনিং টেস্ট এর ফলে প্রাথমিক অবস্থায় শরীরের অস্বাভাবিক পরিবর্তন সমূহ লক্ষ্য করা সম্ভব, এতে চিকিৎসা পদ্ধতি সহজ এবং ফলপ্রসূ হবার সম্ভাবনা বেশী থাকে।
প্রতি বছর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন, প্রতিমাসে নিজেই নিজের স্তন, মুখের ভেতর ও শরীর পরীক্ষা করুন।
দ্রুত ক্যান্সারের সনাক্তকরনের জন্য আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি এর নির্দেশনা
ব্রেস্ট ক্যান্সারঃ
• ৪০ বছর বয়স থেকে প্রতি বছর একবার করে মেমোগ্রাম করতে হবে
• ২০-৩০ বছরের মহিলাদের জন্য ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট পরীক্ষা প্রতি ৩ বছরে একবার এবং চলিশোর্ধ মহিলাদের জন্য প্রতি বছরে একবার
• ২০ বছরের কম বয়সী মেয়েদের জন্য নিজে নিজের ব্রেস্ট পরীক্ষা করা
কোলন ক্যান্সার ও পলিপ
• ৫০ বছর অথবা তদুর্ধ পুরুষ/মহিলাদের জন্যঃ
o ফ্লেক্সিবেল সিগনিওডিস্কপি প্রতি ৫ বছর অন্তর
o কোলনস্কপি প্রতি ১০ বছর অন্তর
• প্রাথমিক ভাবে ক্যান্সার সনাক্তকরনের জন্য প্রতিবছর একবার ফিক্যাল ওকাল্ট ব্লাড টেস্ট (gFOBT) করতে হবে যদি এই টেস্ট পজিটিভ হয় তাহলে কোলনস্কপি করতে হবে
জরায়ু ক্যান্সার
• মাসিক বন্ধের (মেনোপজ) সময় প্রত্যেক মহিলাকে জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি এবং উপসর্গ সম্পর্কে অবহিত করা উচিত। বিশেষ করে কোন অস্বাভাবিক রক্তপাত বা স্পটিং থাকলে অবশ্যই ডাক্তারকে অবহিত করতে হবে
• কিছু কিছু মহিলার মেনোপজ পরবর্তী রক্তপাতের ইতিহাস থাকলে তাঁদের প্রতি বছর ইন্ডোমেটারিয়াল বায়োপসি করার প্রয়োজন হতে পারে
জরায়ুমুখের ক্যান্সারঃ
• সার্ভিক্যাল ক্যান্সার স্ক্রিনিং ২১ বছর বয়স থেকে শুরু করা উচিত, ২১ বছরের কম বয়সী মেয়েদের এই টেস্ট করার প্রয়োজন নেই
• ২১-২৯ বছর বয়সী সকল মহিলাদের প্রতি ৩ বছর পর পর প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট এবং এইচপিভি টেস্ট করতে হবে
• ৩০-৬৫ বছর বয়স্ক মহিলাদের প্রতি ৫ বছর পর পর প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট এবং এইচপিভি টেস্ট করতে হবে
• ৬৫ বছর এর উর্ধ্বে মহিলারা যারা নিয়মিত সার্ভিক্যাল ক্যান্সার স্ক্রিনিং এর মধ্যে ছিলেন এবং রিপোর্ট নরমাল তাঁদের ক্ষেত্রে আর স্ক্রিনিং এর দরকার নেই
প্রস্টেট ক্যান্সারঃ
• প্রস্টেট ক্যান্সারের স্ক্রিনিং ৫০ বছর থেকে শুরু হয় । এটি পিএসএ লেভেলের উপর নির্ভরশীল।
মনে রাখবেন ক্যান্সার মানে মৃত্যু নয়
• এক তৃতীয়াংশ ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব
• এক তৃতীয়াংশ ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য
• অধিকাংশ অনিরাময়যোগ্য ক্যান্সারের ব্যথা উপশম করে জীবনযাপনের মানবৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু নিশ্চিত করা সম্ভব।