স্তন ক্যান্সার সনাক্ত করণ ও তাঁর প্রতিকার
প্রাথমিক অবস্থার ক্যান্সার সনাক্তকরণ এবং আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগের ফলে বিশ্বে আজ বহু নারী স্তন ক্যান্সারের অভিশাপ থেকে মুক্ত। কেবল মাত্র আমাদের দেশেই নয়, বিশ্ব জুড়ে স্তন ক্যান্সারের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে । তাই এর প্রতিকারের জন্য সঠিক ধারণা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্তকরণ।
স্তন ক্যান্সার কি?
“স্তন” লক্ষ লক্ষ কোষের সমন্বয়ে গঠিত একটি অঙ্গ যার একটি মাত্র কোষের অনিয়ন্ত্রিত এবং অস্বাভাবিক বিভাজন থেকে স্তন ক্যান্সার বা টিউমারের উৎপত্তি ।কখনো কখনো কিছু অস্বাভাবিক কোষ স্তন থেকে দেহের অন্যান্য অঙ্গে পৌঁছে জন্ম দেয় কোন টিউমার।
স্তন মূলত কতগুলো দুগ্ধ গ্রন্থি (মিল্ক গ্লান্ড), মায়ের দুধ প্রবাহের জন্য দুগ্ধনালী (ডাক্ট) এবং গ্রন্থিকে ঘিরে থাকা চর্বি ও আঁশ জাতিয় টিস্যু নিয়ে গঠিত ।প্রতিটি গ্রন্থি ১২-১৬ টি লোব এবং প্রতিটি লোব ৩০/৪০ টি লোবিউল এ বিভক্ত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাল্বে এসে শেষ হয় । স্তন ক্যান্সার সাধারণত এসব দুগ্ধনালী বা গ্রন্থির কোষ থেকেই প্রথম শুরু হয়।
ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণ সমূহঃ
- বয়সঃ বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্তন ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বা সম্ভাবনা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
- পারিবারিক ইতিহাসঃ রক্ত সম্পর্কীয় কোন আত্নীয় যদি স্তন, কোলন বা জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তবে আপনার স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কিছুটা বেড়ে যায় । এ ঝুঁকি আরো বৃদ্ধি পায় যদি অতি নিকট জন (যেমন- মা, বোন, খালা, ফুফু) ৫০ বছর বয়সের পূর্বে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন অথবা পরিবারে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা দুই এর অধিক হয় ।অতএব পারিবারিক ইতিহাস থাকলে অতিসত্ত্বর আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- ঋতুস্রাবঃ অল্প বয়সে ঋতুস্রাব শুরু হওয়া এবং বেশি বয়সে স্রাব বন্ধ হলে শরীরে দীর্ঘ দিন ‘ইস্ট্রোজেন’ হরমোনের প্রভাব থাকে, যা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
- হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপিঃ ঋতুস্রাব হওয়ার সময় হলে অনেক মহিলার দীর্ঘ দিন হরমন থেরাপি নিয়ে থাকেন , যা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তবে হরমোন থেরাপি বন্ধ করে এ ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসে।
- জন্মনিয়ন্ত্রন বড়ি গ্রহণঃ দীর্ঘসময় ধরে জন্মনিয়ন্ত্রন বড়ি সেবন স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বাড়িয়ে দেয়। তবে বড়ি সেবন বন্ধ করে দিলে ধীরে ধীরে তা কমে যায়।
- স্থূলতাঃ শরীরে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার সাথে হরমোনের সম্পর্কে থাকায় তা স্তনক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণ ঘটায় ।অতএব ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন । স্বল্প চর্বি যুক্ত খাবার গ্রহন করুন এবং নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন ।
- মদ্যপানঃ মদ্যপানের ফলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায় , অতএব তা পরিহার করুন ।
স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাবেন কি ভাবে ?
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম
সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হালকা শারীরিক পরিশ্রম আপনার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুলাংশে কমাতে পারে । আপনি যত বেশি শারীরিক পরিশ্রম করবেন তত বেশি ঝুঁকি কমাতে সক্ষম হবেন ।
ব্রেষ্ট ফিডিং
শিশুকে স্তন্য পান করানো
শিশুকে দীর্ঘ দিন ধরে (পূর্ণ ২ বছর) মায়ের বুকের দুধ পান করানো হলে শরীর দীর্ঘ সময় ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাব মুক্ত থাকে । ফলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পায় ।
সন্তান গ্রহণ
পরিণত বয়সে সাধারণত ৩০ বছর বয়সের মধ্যে এক থেকে দুটি সন্তান গ্রহন অনেকাংশে আপনার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সক্ষম ।
স্বাস্থ্য সম্মত খাদ্য গ্রহণ
প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় মাংস , চর্বি ও শর্করা জাতীয় খাবার কমিয়ে এবং শাক-সব্জি , ফলমূল ও আঁশযুক্ত খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
স্ক্রিনিং
নিয়মিত ব্রেষ্ট স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যান্সার সনাক্ত করণ সম্ভব যা কিনা রোগ মুক্তির সম্ভাবনা বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়।
ব্রেষ্ট স্ক্রিনিং এর নির্দেশমালা (৪০ বা তদোর্ধ্ব বয়সীদের জন্য)
স্তন ক্যান্সার যত শীঘ্রই নির্ণিত হয় চিকিৎসা তত বেশী সহজ ও ফলপ্রসু হয়।
- ৪০ বছর বয়স থেকে প্রতি বছর একবার করে মেমোগ্রাম করতে হবে
- ২০-৩০ বছরের মহিলাদের জন্য ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট পরীক্ষা প্রতি ৩ বছরে একবার এবং চলিশোর্ধ মহিলাদের জন্য প্রতি বছরে একবার
- ২০ বছরের কম বয়সী মেয়েদের জন্য নিজে নিজের ব্রেস্ট পরীক্ষা করা
**অধিক ঝুঁকিপূর্ণ মহিলাদের (পারিবারিক ইতিহাস থাকলে ) আরো আগে থেকে ডাক্তারের নির্দেশমতে নিয়মিত স্ক্রিনিং করা অত্যাবশ্যক ।
প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্তকরণ অনেক জীবন বাঁচাতে পারে
- আপনার স্তনের স্বাভাবিক সম্পর্কে জানুন
- দেখুন এবং স্পর্শের মাধ্যমে স্তনের স্বাভাবিক অবস্থা অনুভব করুন
- স্তনের কি কি পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রাখবেন তা সম্পর্কে জানুন
- কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করার সাথে সাথে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হউন
- নিয়মিত ব্রেষ্ট স্ক্রিনিং এ অংশে নিন যদি আপনার বয়স ৪০ বা তাঁর চাইতে বেশী হয়ে থাকে।
বয়স বা মাসের সময়ভেদে স্তনের পরিবর্তন হতে পারে তাই স্তনের স্বাভাবিক অবস্থা সম্পর্কে জানুন। এতে করে স্তনের যে কোন অস্বাভাবিক পরিবর্তন সহজেই লক্ষ্য করা সম্ভব। তাই নিজেকে সময় দিন এবং আপনার সময় ও সুবিধা অনুযায়ী নিজ দেহের স্বাভাবিকতা সম্পর্কে অবগত থাকুন।
স্তনের কি কি পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়
অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলারা নিজেরাই প্রথম তাঁদের স্তন এর অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করে থাকেন। কিন্তু সব পরিবর্তনই ক্যান্সারের লক্ষণ নয়, তাই কোন অস্বাভাবিক অবস্থা লক্ষ্যণীয় হলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
লক্ষ্য করুন
- স্তনের আকার, আকৃতি ও রঙ এর পরিবর্তন আছে কিনা
- স্তনের ত্বকে কোন পরিবর্তন (পুরু বা পাকা কমলার খোসার মত) হয়েছে কিনা
- স্তন বা বগলের নীচে কোন চাকা বা পিন্ড অনুভূত হয় কিনা
- স্তন বৃন্তের কোন পরিবর্তন (ডেবে যাওয়া, রস বা রক্ত নিঃসৃত হওয়া) আছে কিনা
- যেকোন এক দিকে ব্যথা অথবা যে কোন ধরনের অস্বস্তি অনুভূত হওয়া
৪০ বা তদোর্ধ্ব বয়সী মহিলাদের জন্য ব্রেষ্ট ক্রিনিং এবং সবাইকে সচেতন করার মাধ্যমেই প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যান্সার সনাক্তকরণ সম্ভব।
মনে রাখবেন
- নারী হয়ে জন্মানোই স্তন ক্যান্সারের একটি ঝুঁকি। তবে পুরুষরাও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে, যা প্রতি ১০০ জন মহিলার অনুপাতে ১ জন (১০০ : ১)।
- স্তনের সকল পরিবর্তনই ক্যান্সার নয়
স্তন ক্যান্সার মানেই নিশ্চিত মৃত্যু নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় হলে, উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগ প্রায় শত ভাগ নিরাময় যোগ্য।