আপনার শরীরের বিভিন্ন অংশে কেমোথেরাপীর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে স্বাভাবিক কোষগুলো ধ্বংস হওয়ার কারণে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হয় কিন্তু কোষগুলো আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়| সুতরাং পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াগুলো সাময়িক| শরীরের যে কোষগুলোতে বেশী পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হয় সেগুলো হচ্ছে—–
১. রক্ত কণিকা কমে যাওয়া
২. চুল পড়া
৩. খাদ্যনালীতে প্রদাহ, আলসার, ডায়রিয়া
৪. স্নায়ু— হাত ও পায়ের আঙ্গুলে ঝিঁ ঝিঁ করা
আপনার জানা থাকা ভাল যে, উপর্যুক্ত প্রতিটি পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সবারই হবে এমনটি নয় আপনার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই আপনার ডাক্তার, নার্স অথবা ফার্মাসিস্ট পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখবেন এবং এগুলোর প্রতিকার আপনাকে জানিয়ে দেবেন
আপনার যে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াগুলো হতে পারে
- মুখের রুচির পরিবর্তন
- ক্ষুধামন্দা
- বমি ভাব/বমি
- মুখে ঘা
- চুল পড়া
- চামড়া এবং নখে পরিবর্তন
- ডায়রিয়া
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- ইনফেকশন ও জ্বর
- রক্ত যাওয়া
- রক্তশূণ্যতা
- অবসাদ ও বিষণ্নতা
- শরীরে ব্যাথা
- হাত ও পায়ে বোধশক্তি কমে যাওয়া, ঝিঁ ঝিঁ ভাব হওয়া
চিকিৎসার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ও প্রতিকারের কিছু উপায়
রক্ত কণিকার সংখ্যা কমে যাওয়া
রক্ত কণিকার সংখ্যা কমে যাওয়ার সাথে ক্যান্সারের সম্পর্ক-
কেমোথেরাপী: কিছু কিছু কেমোথেরাপী ওষুধের জন্য আপনার অস্থি মজ্জা ক্ষতি হতে পারে- হাড়ে কিছু স্পঞ্জ উপাদান পাওয়া যায় আপনার অস্থি মজ্জা রক্ত কণিকা দিয়ে তৈরি, যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় কেমোথেরাপী তাদের জন্য খুব সংবেদনশীল প্রভাব ফেলে কেমোথেরাপী আপনার অস্থি মজ্জায় অনেক কোষ ধ্বংস করে ফেলে কিন্তু এই কোষগুলো পুনঃরায় কিছু সময়ের মধ্যে তৈরি হয় কেমোথেরাপী চিকিৎসায় রক্তের কোন কণিকা কমে যেতে পারে বা আপনি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারেন বিষয়টি আপনার চিকিৎসক বলতে পারবেন কেমোথেরাপীতে সাধারণত শ্বেত কণিকা (white blood cell) বেশী ধ্বংস হয়
- রেডিওথেরাপী : যদি আপনি শরীরের বড় অংশে রেডিওথেরাপি নিয়ে থাকেন বিশেষ করে বড় হাড় যেমন আপনার পেলভিস, পায়ে বা বুকে তাহলে আপনার অস্থিমজ্জায় রক্তের লাল বা সাদা কণিকা কমে যেতে পারে রেডিওথেরাপী অনুচক্রিয়া (Paltelete) এর উপর কম প্রভাব ফেলে বলে মনে করা হয়
- রক্ত এবং অস্থিমজ্জার (bone marrow) সাথে ক্যান্সার সম্পর্ক: লিউকোমিয়া, অস্থিমজ্জা এবং রক্তের স্বাভাবিক কোষ বিকাশ করতে বাধা প্রদান করে
- ক্যান্সার বিস্তার (Metastasize) : ক্যান্সার কোষ টিউমার থেকে ভেংগে গিয়ে আপনার সমস্ত শরীরে বিস্তার করে সেই সাথে আপনার অস্থিমজ্জাতেও যে সমস্ত ক্যান্সার আপনার অস্থিমজ্জায় ছড়িয়ে পড়ে তার কিছু উদাহরণ হল –স্তন ক্যান্সার এবং প্রোষ্টেট ক্যান্সার ক্যান্সারের কোষগুলো আপনার অস্থিমজ্জা থেকে অন্যান্য অংশে স্থানচ্যুত হতে পারে তখন আপনার শরীরের জন্য রক্তের কণিকা উৎপাদন, অস্থিমজ্জা এর জন্য কঠিন হয়ে যায়
রক্তে কোষের সংখ্যা পরীক্ষা করা আপনার জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ
কম রক্ত কণিকা আপনার চিকিৎসার পরবর্তী রাউন্ডের জন্য সাংঘাতিক জটিলতা তৈরী করতে পারে
রক্তের কণিকার সংখ্যা পরীক্ষা করে আপনার চিকিৎসক আপনার ঝুঁকি প্রতিরোধ করতে পারেন বা কমাতে পারেন রক্ত কণিকার সংখ্যা কমের কারণ আপনার অনেক জটিলতা হতে পারে যেগুলো হলঃ
সংক্রমণ (Infection)
শ্বেত রক্ত কণিকার সংখ্যা কমে যাওয়ার সাথে বিশেষ করে নিউট্রোলিফের (Neutrophils) সংখ্যা কমে যায় যা রক্তের সংক্রমণের সাথে যুদ্ধ করে যার কারণে আপনার সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে যখন আপনার শ্বেত রক্ত কণিকার সংখ্যা কমে যায় আর যদি আপনার সংক্রমণ বেশি হয় তাহলে আপনি নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন না সংক্রমণ গুরুতর হলে মৃত্যুও হতে পারে এমনকি সংক্রমণ যদি হালকা হয় তাহলেও আপনার কেমোথেরাপি চিকিৎসা বিলম্ব হবে কেননা আপনার ডাক্তার ততক্ষণ অপেক্ষা করবেন যতক্ষণ না আপনার সংক্রমণ শেষ হয়ে পূর্বের মত রক্ত কণিকার সংখ্যা হয়
এছাড়াও আপনার ডাক্তার আপনাকে রক্তে শ্বেত রক্ত কণিকা উৎপাদনের জন্য ওষুধ দিতে পারেন
রক্তশূণ্যতা/রক্তস্বল্পতা (Anaemia)
রক্তে লোহিত কণিকা কমে যাওয়া হল রক্তশূণ্যতা রক্তস্বল্পতার সাধারণ লক্ষণ বা উপসর্গগুলো হলো- ক্লান্তি এবং শ্বাসকষ্ট কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্লান্তি এমন বেশি হয় যে এ কারণে সাময়িকভাবে আপনার চিকিৎসা স্থগিত করতে হয় বা আপনার ওষুধের ডোজ কমাতে হতে পারে রক্তশূণ্যতা কমাতে পারেন রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে অথাব ওষুধের সাহায্যে রক্তে লোহিত রক্ত কণিকা উৎপাদনের মাধ্যমে
রক্তবরণ (Bleeding)
আপনার রক্তে অনুচক্রিয়া সংখ্যা কমলে রক্তপাত হতে পারে আপনার একটি ছোট কাটা থেকে বা আপনার নাক বা মাড়ি থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রক্তপাত হবে ভিতরের রক্তপাত খুব বিপদজ্জনক হতে পারে অনুচক্রিকা কমে গেলে আপনার চিকিৎসার বিলম্ব হতে পারে প্লেটলেট পূর্বের সংখ্যায় ফিরে আসা পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে এ ক্ষেত্রে আপনার চিকিৎসক আপনার কেমোথেরাপি চিকিৎসা বা সার্জারীর তারিখ প্রয়োজনে পুণ:নির্ধারণ করবেন
আপনার চিকিৎককে জিজ্ঞাসা করুন আপনার ক্যান্সার চিকিৎসায় রক্ত কণিকার সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ কি এবং লক্ষণ কি এবং আপনার জন্য কি উপসর্গ দেখা দিতে পারে যদি আপনি রক্তে কণিকার সংখ্যা কমে যাওয়ার লক্ষণ বা উপসর্গ বুঝতে পারেন তাহলে সরাসরি আপনার চিকিৎসককে বলুন
অবস্থা (Condition) | পর্যবেক্ষণ (Observation) |
শ্বেত রক্ত কণিকার সংখ্যা কমে গেলে |
|
লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা কমে গেলে |
|
অনুচক্রিকা কমে গেলে |
|
রক্ত কণিকার সংখ্যা কমে গেলে কিভাবে চিকিৎসা করা হয়?
যদি আপনার রক্তে কণিকার সংখ্যা কম থাকে তাহলে আপনার তার উপর ভিত্তি করে বা কারণ বের করে চিকিৎসা দিতে হবে
প্রচলিত কিছু চিকিৎসা:
রক্ত সঞ্চালন: রক্তের লোহিত কণিকা বা প্লেটলেটের সংখ্যা কমে গেলে আপনি রক্তদাতার রক্ত থেকে তা নিতে পারেন
ওষুধ বা মেডিকেশান: আপনার ডাক্তার আপনাকে রক্ত কণিকা বাড়ানোর জন্য যে ওষুধ দিবেন তার কিছু ভালো দিক আছে আবার ক্ষতিকর দিকও আছে সেগুলোর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আপনার ডাক্তারকে আপনি জিজ্ঞাসা করুন
চিকিৎসা বন্ধ : গুরুতর ক্ষেত্রে বা আপনার রক্তের কণিকা বৃদ্ধির জন্য আপনার জন্য আপনার ক্যান্সার চিকিৎসা বিলম্ব হতে পারে
রক্তে কণিকার সংখ্যা কমে গেলে আপনি কিভাবে মানিয়ে নিবেন?
রক্তে কোষের সংখ্যা কমে গেলেও আপনার শরীর সুস্থ্য রাখার জন্য কিছু পদক্ষেপ যেমন:
সুষম খাদ্য খাওয়া: আপনার শরীরের জন্য ভিটামিন এবং পুষ্টির প্রয়োজন এটা চিকিৎসার আগে ও পরে নিজের সুস্থ্যতার জন্য প্রচুর পরিমান ফল ও সবজি খান যদি চিকিৎসার সময় খাওয়ার কারণে কিছু জটিলতা হয় যেমন- বমি বমি ভাব বা বমি বা মুখে ঘা হয় তাহলে আপনি সহ্য করতে পারেন এমন খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন
আঘাত এড়িয়ে চলুন: নিজেকে কাটা বা আঁচড়ের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করুন প্লেটলেট কমে গেলে ছোট খাটো ঘর্ষণও গুরুতর হতে পারে শ্বেতরক্ত কণিকা কম থাকলে যে কোন কাটা স্থানে সংক্রমণ হতে পারে জোর পরিহার করুন এবং সেফটি শেভার ব্যবহার করুন অন্য কাউকে খাদ্য কাটার জন্য রান্নাঘরে পাঠান খুব ধীরে দাঁত ব্রশা করুন এবং নাক ধৌত করুন
জীবাণু এড়িয়ে চলুন: যদিও সব জীবাণু এড়ানো অসম্ভব কিন্তু আপনি অপ্রয়োজনীয় কিছু প্রভাব থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেন ঘন ঘন আপনার হাত ধুয়ে একটি তরল জীবানুনাশক (Sanitizer) ব্যবহার করুন অসুস্থ মানুষ এবং জনতার থেকে দূরে থাকুন অন্য কাউকে দিয়ে বাক্স, পাখির খাঁচা বা মাছের ট্যাংক পরিষ্কার রাখুন কাঁচা মাংস, ডিম খাবেন না নাকে মাস্ক ব্যবহার করুন ব্যবহারের পূর্বে থালা ও গ্লাস ফুটন্ত পানিতে ধুয়ে নিন
বিশ্রাম: আপনি যদি ক্লান্তি অনুভব করেন বিশ্রাম করুন আপনার কঠিন পরিশ্রম করতে হয় ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করতে, সুস্থ কোষকে বাঁচাতে যখন আপনি নিজেকে শক্তিশালী মনে করবেন তখন আপনি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো পরিকল্পনা করুন
নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিলে সরাসরি আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন:
ত্বক
- ছোট ছোট লাল র্যাশ অথবা বিচি দেখা দিলে, সাধারণত হাতে ও পায়ে এইগুলো হয়
- ছোপ ছোপ কালো দাগ
চোখ
- চোখের সাদা অংশে রক্ত জমা
- চোখে ঝাপসা দেখা
মুখ ও নাক
- দাঁতের গোড়া ও মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ
- মুখের লালা অথবা কাশির সাথে রক্তক্ষরণ
- নাক দিয়ে রক্তক্ষণ
পরিপাকতন্ত্র
- রক্ত বমি
- কালো পায়খানা (মল)
- মলের রং লালচে হওয়া
মূত্র
- লালচে প্রস্রাব অথবা প্রস্রাবের সাথে রক্ত
- প্রস্রাব করার সময় ব্যথা
- মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্ত যাওয়া
- মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রক্ত যাওয়া
অন্যান্য উপসর্গ
- প্রচন্ড মাথা ব্যথা, ঝিমুনী ভাব, প্রচন্ড দুর্বলতা, মাংস পেশীতে অথবা গিরায় ব্যথা