কোলোরেক্টাল ক্যান্সার
কোলোরেক্টাল ক্যান্সার কি?
কোলোরেক্টাল ক্যান্সার, মলাশয়ের ক্যান্সার ও মলদ্বারের ক্যান্সার নামেও পরিচিত। এই ক্যান্সার শতকরা ৯০ ভাগ প্রতিরোধ যোগ্য। শুরুতে এটি আঙ্গুর আকৃতির পলিপ আকারে দেখা যায়, যা পরবর্তীতে ক্যান্সারে রুপান্তরিত হয়। নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে পলিপ খুঁজে পাওয়া যায় যা ক্যান্সার হওয়ার পূর্বেই অপসারণ করা সম্ভব। সারা বিশ্বে ক্যান্সার আক্রান্তদের মধ্যে ৯.৪ শতাংশ পুরুষ ও ১০.১ শতাংশ নারী কোলোরেক্টাল ক্যান্সারে আক্রান্ত। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে ২০০৫ সালে ৬৫৫০০০ জন কোলোরেক্টাল ক্যান্সারে মারা গেছে। এই ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কারা ঝুকিপূর্ণ?
কোলোরেক্টাল ক্যান্সার দ্বারা নারী পুরুষ যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই ঝুঁকি বাড়তে থাকে। চল্লিশোর্ধ সকল নারী পুরুষের নিয়মিত পরীক্ষা (স্ক্রিনিং টেস্ট) করানো উচিত।
অনেকেই আছেন যারা কোলোরেক্টাল ক্যান্সারে বেশী ঝুকিপূর্ণ। এই ক্যান্সারের সম্ভাব্য কারণঃ
• উচ্চ প্রাণীজ চর্বি ও প্রোটিন এবং কম আঁশ জাতীয় খাবার গ্রহণ
• পরিবারের কারো কোলোরেক্টাল পলিপ, ক্যান্সার বা আলসার থাকা
• তামাক জাতীয় পদার্থ ব্যবহার
• ওজন বেশী
• সারাক্ষণ বসে কাজ করা
লক্ষণ সমূহ
• রক্ত যুক্ত মল বা মল ত্যাগের সময় রক্ত নিগর্মন
• তলপেটে কিংবা মলদ্বারে ব্যথা
• মল ত্যাগের স্বাভাবিক অভ্যাস পরিবর্তন যেমন ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য ছয় মাসের বেশী স্থায়ী হওয়া
• পরিমাণে অল্প মল
• পেট ফেঁপে থাকা, ক্ষুধামন্দা
• সহসা অজানা কারণে ওজন কমে যাওয়া
• সার্বক্ষনিক অবসাদ
প্রতিরোধ
নিয়মিত পরীক্ষা-
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ পরীক্ষা দ্বারা সহজেই পলিপ নির্ণয় করতে পারেন এবং সেটা ক্যান্সারে রূপান্তরিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেন। বিভিন্ন ধরণের কোলোরেক্টাল স্ক্রিনিং টেস্ট আছে। কোন রোগীর জন্য কোন পরীক্ষা উপযোগী তা একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই পরামর্শ দিতে পারেন। ৪০ বছর বয়সের শুরুতে-
– ফিকাল অকাল্ট ব্লাড টেস্ট (FOBT) বা ফিকাল ইমিউনোক্যামিকেল টেস্ট (FIT) – প্রতি বছর ১ বার
– ফ্লেক্সিবল সিগময়েডোস্কোপি- প্রতি ৫ বছরে ১ বার
– ডাবল-কন্ট্রাস্ট বেরিয়াম এনেমা- প্রতি ৫ বছরে ১ বার
– কোলোনোস্কোপি- প্রতি ১০ বছরে ১ বার
– ফিকাল অকাল্ট ব্লাড টেস্ট (FOBT) এবং ফ্লেক্সিবল সিগময়েডোস্কোপি- একসঙ্গে প্রতি ৫ বছরে ১ বার
ব্যায়াম-
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম একজন মানুষের কোলোরেক্টাল ক্যান্সার এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি কমায়। ব্যায়াম মলাশয়ে পলিপ হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন ৩০-৬০ মিনিট হালকা ব্যায়াম যেমন- হাঁটা, বাগানের পরিচর্যা করা অথবা সিড়ি দিয়ে ওঠা নামা করা উচিত।
ওজন নিয়ন্ত্রণ-
মুটিয়ে যাওয়ার সাথে কোলোরেক্টাল ক্যান্সার এবং আরও অনেক রোগের সম্পর্ক আছে। অতিরিক্ত ওজন শরীরে অনেক হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
চর্বি জাতীয় খাবার-
অধিক চর্বি জাতীয় খাবার ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা বাড়ায়। যে সব দেশে অধিক চর্বি জাতীয় খাবার বেশী খাওয়া হয়, সে সব দেশে কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের প্রবণতা বেশী। আপনার খাদ্যাভ্যাস কম চর্বিযুক্ত করুন। আপনি প্রতিদিনের খাবার থেকে যে পরিমাণ ক্যালরি বা শক্তি পান তার এক তৃতীয়াংশের বেশী চর্বি জাতীয় খাবার থেকে আসা উচিত নয়। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে প্রাণীজ চর্বি ঘি, মাখন,মাংসের তেল ইত্যাদি কম খান এবং বেশী বেশী টাটকা শাক-সবজি ও ফলমূল খান।
উদ্ভিতজাত খাবার-
অসংখ্য গবেষণায় প্রমাণীত, উদ্ভিদজাত খাদ্য, তাজা ফল, শাক –সবজি এবং শস্য স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এ সমস্ত স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য সারা জীবন আপনাকে নানা ক্যান্সার থেকে রক্ষা করতে পারে। প্রতিদিন যে কোন একটি ফল, দুপুর ও রাতের খাবারে অন্তত ১ কাপ পরিমাণ শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস করা উচিত।
চিকিৎসা
বর্তমানে উন্নত বিশ্বের মত আমাদের দেশেও কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের চিকিৎসা হচ্ছে। এখন রোগীরা ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশ্বমানের সেবা (চিকিৎসক, হসপিটাল, রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি ও ওষুধ) দেশেই পাচ্ছেন। রোগীর বয়স, রোগের অবস্থা যেমন- ক্যান্সারের আকার, অবস্থান এবং কতটুকু বিস্তার লাভ করেছে এর উপর নির্ভর করে এসব চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সাধারণত কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের চিকিৎসা সমূহ হল-
সার্জারীঃ কোলোরেক্টাল ক্যান্সার, যে সব ক্ষেত্রে শারীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েনি তাদের জন্য প্রধাণ চিকিৎসা হচ্ছে সার্জারী। সার্জারীর সাথে রেডিওথেরাপী বা কেমোথেরাপী সমন্বিত ভাবে দেয়া হয়।
রেডিওথেরাপীঃরেডিওথেরাপী সার্জারী ও কেমোথেরাপীর সাথে দেয়া হলে ক্যান্সার পুনরায় হবার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়।
কেমোথেরাপীঃ সার্জারি পরবর্তী কেমোথেরাপী ক্যান্সার পুনরায় হওয়া কিংবা শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কমায়।
নতুন চিকিৎসা
এন্টি- অ্যানজিওজেনিক এজেন্ট (মনোক্লোনাল এন্টিবডি) যা কেমোথেরাপীর সাথে সমন্বিতভাবে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পেয়েছে। এটি ক্যান্সার কোষে রক্ত সঞ্চালনে বাঁধা দিয়ে ক্যান্সারের বৃদ্ধি ও ছড়িয়ে পরা রোধ করে।
প্রতিরোধই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। তাই পলিপ ক্যান্সারে রূপান্তরিত হওয়ার পূর্বেই সার্জারির মাধ্যমে অপসারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুরুতেই ধরা পরলে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ। আপনি পরীক্ষা করতে যত দেরী করবেন, ক্যান্সার তত বেশী আপনার শরীরে ছড়িয়ে পরবে এবং চিকিৎসার ফলাফল আশানুরূপ হবে না।