পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও ফুসফুস ক্যান্সার পুরুষদের এক নম্বর ক্যান্সার। নারীদের মধ্যে এ রোগীর সংখ্যা কম নয়। ক্যান্সার জনিত মৃত্যুর প্রধাণ কারণও ফুসফুস ক্যান্সার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ রোগ তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ে সনাক্ত হয়ে থাকে। তখন বিভিন্ন প্রকার উপসর্গ দেখা যায়। ক্যান্সার নিরাময় করার মত চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনা। চিকিৎসার বিভিন্ন আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করেও ফুসফুস জনিত মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হচ্ছেনা। তাই দেশে দেশে ফুসফুস ক্যান্সার প্রতিরোধে জোর প্রচারণা চলছে। এ রোগের প্রতিরোধ অনেক সহজ, কার্যকর, সাশ্রয়ী এবং দীর্ঘমেয়াদী।
ফুসফুসের কোন কোষ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে ক্যান্সার কোষে রূপ নেয়। এ কোষ স্বাভাবিক কোষ হতে আলাদা। যেমন আকার আকৃতিতে তেমনি কার্যকারিতায়। একসময় এই কোষই জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ক্যান্সার কোষটি দ্রুত বিভাজিত হয়ে কোষ সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটাতে থাকে। কোষ সংখ্যার এ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রনহীন ও অস্বাভাবিক। এর ফলে ক্যান্সার একটি পিণ্ডের আকার ধারণ করে। এক্স-রে এবং সিটি-স্ক্যান প্লেটে এর ছবি দেখতে পাওয়া যায়। ক্যান্সার পিণ্ডটি বড় হতে থাকে এবং দূরের অঙ্গে ছড়িয়ে যায়। যার নাম মেটাসটেসিস।
ধূমপান ফুসফুস ক্যান্সারের প্রধাণ কারণ। ১৯৫০ সাল হতে অসংখ্য গবেষণায় প্রাপ্ত একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। ফুসফুস ক্যান্সারের ৯০% কারণ প্রত্যক্ষ ধূমপান।
- সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রায় ৪০০ প্রকার রাসায়নিক পদার্থ আছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান (কার্সিনোজেন)।
- যিনি দিনে এক প্যাকেট সিগারেট খান, তার ফুসফুস ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অধূমপায়ীর চেয়ে ২৫-৩০ গুন বেশি।
ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকির পরিমাণ ততই বেশি হয়, যত অল্প বয়সে ধূমপান শুরু করা হয়, যত বেশি পরিমাণে ধূমপান করা হয় Ges যত দীর্ঘদিন ধূমপানে অভ্যস্ত থাকা হয়।
- পরোক্ষ ধূমপান। ব্যক্তি নিজে ধূমপান করেন না। তবে দীর্ঘদিন পাশে থেকে অন্যের ধূমপানের ধোঁয়া গ্রহণ করেন।
- তামাক পাতা যেমন জর্দা, সাদাপাতা, গুল ব্যবহার করা।
- বায়ূ দূষণ- গাড়ি, কলকারখানার ধোঁয়া, জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত কাঠ, কয়লা ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ পোড়ানো হতে নির্গত কালো ধোঁয়া বায়ুকে দূষিত করে। দীর্ঘ দিন এ ধরণের দূষিত বায়ুতে বসবাস করলে ফুসফুস ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন দীর্ঘদিন দূষিত বায়ুতে বাস করা এবং দীর্ঘদিন পরোক্ষ ধূমপান করা ফুসফুস ক্যান্সারের জন্য অনেকটা সমান ঝুকিপূর্ণ।
- কলকারখানায় ব্যবহৃত হয় এসবেস্টোস। এসবেস্টোস এক প্রকার আঁশ জাতীয় পদার্থ যা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এসবেস্টোস ফুসফুসের ক্ষত সৃষ্টি করে এবং ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি নয় গুন বাড়িয়ে দেয়। ধূমপায়ীরা এ পরিবেশে দীর্ঘ সময় অবস্থান করলে এ রোগের ঝুঁকি ৫০ হতে ৯০ গুন বেড়ে যায়। এসবেস্টোস দ্বারা সৃষ্ট হয় মেজোথেলিওমা নামক অন্য আর এক ধরণের ফুসফুস ক্যান্সার।
- ফুসফুসের অন্যান্য রোগ- দীর্ঘদিন ফুসফুসের প্রদাহ স্থায়ী হলে ফুসফুসের বিভিন্ন নালী- প্রণালীতে পরিবর্তন হয়। ফুসফুসের বাতাস সহসা বের হয়ে আসতে পারেনা এবং বিভিন্ন রোগ বা সমস্যা দেখা দেয়। যেমন ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারী ডিজিস (COPD), এনফাইজেমা ও যক্ষ্মা রোগ। এ সকল রোগীরা ধূমপায়ী হলে ফুসফুস ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বহু গুন বেড়ে যায়।
- রেডন গ্যাস ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি।
- আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, নিকেল, এরোমেটিক হাইড্রোকার্বনস এবং ইথার ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থ থাকা পরিবেশের মধ্যে দীর্ঘদিন অবস্থান করলে, ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- পরিবারে ফুসফুস ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে।
- একবার এক ফুসফুসে ক্যান্সার হলে অপরটিতে আবার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
dzmdzm K¨vÝv‡ii ms‡KZ
প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করা গেলে প্রায় সকল ধরণের ক্যান্সা নিরাময় করা সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করতে হলে এ রোগ সম্পর্কে জানতে হবে। একবারে প্রাথমিক পর্যায়ে ফুসফুস ক্যান্সারের কোন লক্ষণ থাকে না। তবে নিম্নলিখিত সমস্যা গুলোকে ফুসফুস ক্যান্সারের সংকেত হিসেবে গণ্য করা হয়।
- দীর্ঘদিন স্থায়ী কাশি। কাশির জন্য চিকিৎসা করা হয়েছে, কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কাশি কমছে না, কাশির মাত্রা বেড়েই যাচ্ছে। কাশির সাথে রক্ত পড়া।
- এমনিতে তেমন কোন শ্বাসকষ্ট নেই। তবে কাজকর্ম করতে গেলে সামান্য পরিশ্রমে শ্বাসকষ্ট বোধ হওয়া।
- বুকে, পিঠে, বাহুতে ব্যথা অনুভব করা বা অস্বস্তি বোধ হওয়া। কাশি বা শ্বাস-কষ্ট হওয়ার আগেও এ ধরণের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। বুকে পিঠে আঘাত পাওয়ার কোন ঘটনাও ঘটেনি কিন্তু তারপরও ব্যথা অনুভূত হওয়া। শতকরা ৫০% ফুসফুস ক্যান্সার রোগী বুকে পিঠে ব্যথা প্রথম রোগ সনাক্ত হয়ে থাকে।
- খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া।
- প্রায়ই ফুসফুসে প্রদাহ (ব্রংকাইটিস) হওয়া।
- ওজন কমে যাওয়া
- দুর্বল
ক্যান্সার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে গেলে আরো অনেক উপসর্গ ও চিহ্ন দেখা দিতে পারে। ফুসফুসের অন্যান্য রোগ বিশেষ করে যক্ষ্মা হলেও উল্লিখিত উপসর্গ গুলো দেখা যেতে পারে। যক্ষ্মা হয়েছ নিশ্চিত না হয়েই শুধু মাত্র লক্ষণ দেখে রোগের চিকিৎসা শুরু হয়ে যায়। ক্যান্সার রোগী ৫/৬ মাস দেরি করে আসেন। এ জন্য প্রায়ই ফুসফুস ক্যান্সার তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে সনাক্ত হয়ে থাকে।
কিছু নিয়ম কানুন মেনে চললে, জীবন যাপন ও খাদ্যvভ্যাস পরিবর্তন করলে ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কমে আসে।
- কখনো ধূমপান না করা। পরিবারের অন্যরাও যাতে ধূমপান না করতে পারে সেই পরিবেশ গড়ে তোলা।
- ধূমপায়ী হলে, এখনি তা বন্ধ করা। ধূমপান বন্ধ করতে নিজে সক্ষম না হলে, চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া।
- পরোক্ষ ধূমপানের শিকার না হওয়া। যেখানে সব সময় ধূমপান চলে, সেখানে অবস্থান না করা।
- কর্মক্ষেত্রে কার্সিনোজেন এড়িয়ে চলা। কর্মক্ষেত্রে যদি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে, তাহলে চাকুরীর বিধিতে শারীরিক সুরক্ষার জন্য যে সকল সতর্ক নিয়ম কানুন আছে তা ঠিক ঠিক ভাবে মেনে চলা। সুরক্ষার জন্য মুখে মাস্ক দেয়া হলে, কাজের সময় তা ব্যবহার করা।
- বাড়ির পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়া। কর্মক্ষেত্রে যেমন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে, বাড়িতেও বিভিন্ন কিছুতে এ সকল পদার্থ অগোচরে থাকতে পারে। বিশেষ করে রান্নার কাজে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত কাঠ, পাতা, কয়লা, পাটখড়ি, ময়লা কাগজ ইত্যাদি পোড়ানোর ধোঁয়া ঘরের ভিতর গিয়ে পরিবেশ দূষY ঘটায়। ঘরের ভেতরের বাতাস যেন বাইরে চলাচল করতে পারে সে ধরণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- নিয়মিত ব্যায়াম করা। এমনকি সপ্তাহে দুদিন হালকা ধরণের ব্যায়ামও ফুসফুসে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
- খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরণের ফল ও শাক সবজি খাওয়া। বিভিন্ন প্রকার ফল, শাক-সব্জি ও তরকারিতে যে পরিমান ভিটামিন থাকে তা প্রক্রিয়াজাত ওষুধে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে ইন-অরগানিক ফসফেট যুক্ত খাবার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ইন-অরগানিক ফসফেট যুক্ত খাবারের মধ্যে আছে প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন মাংস, ফাস্ট-ফুড, বেকারী খাবার এবং বিভিন্ন ধরণের কার্বোনেটেট কোলা ড্রিংক। এ ধরণের খাবার কম খাওয়ার অভ্যাস করা।
- গ্রীন টি খাওয়ার অভ্যাস করা। নিয়মিত গ্রীন টি পান করলে ধূমপানে সৃষ্ট কোষের ক্ষতি কিছুটা কমে। এর ফলে ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি কম থাকে।